নিজস্ব প্রতিবেদক: নামাজ—মুসলমানদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু, ইমানের প্রতিফলন। আর জামাতে আদায়কৃত নামাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো—ইমামের তাকবির। অনেক সময় দেখা যায়, ইমাম সাহেব নামাজে অতিরিক্ত নিচু স্বরে তাকবির দেন, ফলে পেছনের মুসল্লিরা ঠিকভাবে তা শুনতে পান না। প্রশ্ন উঠতে পারে—ইমাম যদি নিচু স্বরে তাকবির দেন, তাহলে কি মুসল্লির নামাজ নষ্ট হয়ে যায়? কিংবা ইমামের এই আচরণ কি সুন্নাহবিরোধী?
আজকের এই প্রতিবেদন সেই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা—সহিহ দলিল, ফিকহি ব্যাখ্যা ও সাহাবায়ে কেরামের জীবন থেকে।
ইমামের তাকবির জোরে বলার বিধান
ইমামের জন্য তাকবির উচ্চস্বরে বলা সুন্নতে মুয়াক্কাদা, যাতে পেছনে অবস্থানরত মুসল্লিরা তার অনুসরণ করতে পারেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও নামাজে তাকবির এমনভাবে বলতেন, যা সাহাবারা স্পষ্টভাবে শুনতে পেতেন। তাই জোরে তাকবির বলা শুধু রেওয়াজ নয়—সুন্নতেরই অংশ।
তবে যদি ইমাম নিচু স্বরে তাকবির দেন, তাহলে এর ফলে নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে কি?
না, যাবে না।
যেহেতু তাকবির দেওয়া ফরজ নয় বরং সুন্নত, তাই নিচু স্বরে বলা হলেও নামাজ সহীহ (শুদ্ধ) হবে। এক্ষেত্রে সাহু সিজদা করতেও হবে না, কারণ এটি কোনো ওয়াজিবের ত্যাগ নয়।
তাকবিরে উলার তাৎপর্য: হারানো ফজিলতের গল্প
নিচু স্বরে তাকবির বলার মাধ্যমে যে জিনিসটি অনুপস্থিত হয়ে পড়ে, তা হলো—তাকবিরে উলা। ইমামের প্রথম তাকবিরকে ইসলামি পরিভাষায় বলা হয় তাকবিরে উলা। এই তাকবির পাওয়া একজন মুসল্লির জন্য শুধু ফজিলত নয়, বরং এক ঐশী পুরস্কারের চাবিকাঠি।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন জামাতে নামাজ আদায় করবে এবং সে প্রথম তাকবিরও পাবে— তার জন্য দুটি মুক্তির সনদ লেখা হবে:
(১) জাহান্নাম থেকে মুক্তি;
(২) মুনাফিকি থেকে মুক্তি।”
(সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৪১)
তাই ইমামের নিচু স্বরের কারণে যদি মুসল্লি প্রথম তাকবির বুঝতেই না পারে, তাহলে এই মহা ফজিলত থেকে সে বঞ্চিত হয়ে যেতে পারে।
সাহাবায়ে কেরামের চোখে তাকবিরে উলা
বিখ্যাত তাবেয়ি মুজাহিদ (রহ.) এক সাহাবির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন:
এক বদরী সাহাবি তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন—
“তুমি কি আমাদের সঙ্গে নামাজ পেয়েছ?”
ছেলে বলল, “জি।”
সাহাবি বললেন, “তাকবিরে উলা পেয়েছ?”
ছেলে বলল, “না।”
তখন সাহাবি বলেন,
“তুমি একশো কালো চোখবিশিষ্ট উটের চেয়েও বেশি কল্যাণ হারিয়েছ।”
(মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস: ২০২১)
এই বক্তব্য শুধু আবেগ নয়, এক গভীর ইসলামী মূল্যবোধের প্রকাশ—তাকবিরে উলা মানে হলো, নামাজের সূচনা থেকেই আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়া।
ইমামদের প্রতি পরামর্শ
ইমামতির দায়িত্ব শুধুমাত্র কেরাত পড়া নয়, বরং এটি এক নেতৃত্বের জায়গা। একজন ইমাম যদি নিচু স্বরে তাকবির দেন, মুসল্লিরা বিভ্রান্ত হতে পারেন, রুকু বা সেজদা মিস করতে পারেন, এমনকি ভুল ফলো করে বসেন। তাই শরিয়ত অনুযায়ী ইমামের উচিত:
অভ্যাস অনুসারে উচ্চস্বরে তাকবির দেওয়া
জামাতের সারি অনুসারে কণ্ঠের ভলিউম সামঞ্জস্য রাখা
নামাজের প্রতিটি দফায় স্পষ্টভাবে দিকনির্দেশ দেওয়া
মুক্তাদীদের করণীয়
যদি কোনো ইমাম নিচু স্বরে তাকবির বলেন, তাহলে মুক্তাদীর উচিত:
চোখ-কান খোলা রেখে ইমামের অঙ্গভঙ্গি বুঝে ফলো করা
সুযোগ থাকলে সামনে থাকা ব্যক্তির অনুসরণ করা
প্রয়োজন হলে ইমামকে নম্রভাবে বিষয়টি অবহিত করা
নিচু স্বরে তাকবির বললে নামাজ শুদ্ধ থাকবে, কিন্তু তাকবিরে উলার ফজিলত পেতে সমস্যা হতে পারে।
মুসল্লিরা যেমন সময়মতো এসে জামাতে শরিক হওয়ার চেষ্টা করবেন, তেমনি ইমামদেরও উচিত তাকবির উচ্চস্বরে বলা।
নিচু স্বরে তাকবির দিলে নামাজ নষ্ট হয় না—তবে হারিয়ে যায় এমন কিছু, যা শুধু রাকাতের সংখ্যা নয়, বরং জান্নাতের দরজার সঙ্গে সম্পর্কিত।
তথ্যসূত্র:
সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৪১
মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস: ২০২১
হানাফি ফিকহ: তাকবির ও জামাত সংক্রান্ত ব্যাখ্যা
আব্দুর রহিম/
নিউজটি আপডেট করেছেন : Jatiyo Potrika
নিচু স্বরে তাকবির দিলে নামাজ নষ্ট হবে? জানুন স্বর্ণময় উত্তর
- আপলোড সময় : ২২-০৭-২০২৫ ১০:৫৮:২৭ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২২-০৭-২০২৫ ১০:৫৮:২৭ অপরাহ্ন

সর্বশেষ সংবাদ